জাতীয় শোক দিবস হলো বাংলাদেশের একটি জাতীয় দিবস। প্রতিবছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিবসটি শোকের সাথে পালন করা হয়। এ দিবসে কালো পতাকা উত্তোলন ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
জাতীয় শোক দিবস অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করা হয় এবং তাঁর আদর্শ ও ত্যাগের কথা স্মরণ করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত মুক্ত দেশকে রক্ষা করার শপথ করা হয়।
জাতীয় শোক দিবসের দিন সরকারি ও বেসরকারি সব অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। টেলিভিশন ও রেডিওতে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শোক দিবসকে কেন্দ্র করে নানান অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
জাতীয় শোক দিবসের ব্যানার। ছবি: আওয়ামীলীগ ওয়েবসাইট |
সেদিন কী ঘটেছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে?
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন ভোরে, কয়েকজন বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা তার বাসভবন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অভিযান চালায় এবং তাকে, তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, তার তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল, এবং তার ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে।
শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন দেশে না থাকায় রেহাই পান বলে ধারণা করা হয়।
আওয়ামীলীগ দাবি করে, শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং জাতির পিতা। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ নেতা এবং দেশপ্রেমিক। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশবাসী গভীর শোক ও দুঃখের মধ্যে পড়েছিল।
কী হয় জাতীয় শোক দিবসে
সূর্য উদয় ক্ষণে - বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে সংগঠনের সকল স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে তার প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এছাড়াও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনসহ মহানগরের প্রতিটি শাখার নেতাকর্মীরা যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
এরপর - বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, কবর জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল হয়।
বনানীর পর - টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর একটি প্রতিনিধি দল, গোপালগঞ্জ জেলা ও টুঙ্গীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ-এর নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকেন।
কিছু তরুণ-তরুণী এ দিবসে নাচ গানের আয়োজন করে। যা নিয়ে সমালোচনা হয় সাধারণ মহলে।
আরো পড়ুন: কানে ‘মুজিব’ ছবির ট্রেলার উদ্বোধন
হত্যাকাণ্ডের বিচার
আওয়ামীলীগ এর ওয়েবসাইটে বলা হয়- ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বাঙালি জাতির কলঙ্কমুক্তির দিন। এদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারী ৫ খুনি ফাঁসিতে ঝুলেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে।
জেনারেল জিয়াউর রহমানও রাষ্ট্রপতি হয়ে বিচারের কোন ধরনের ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। ১৯৭৯ সালে তিনি ছিয়াত্তরে মুশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন দিয়ে সংবিধানে সন্নিবেশ করেন।
হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’বাতিল করে হত্যাকাণ্ডটির বিচারের পথ তৈরি করা হয়।
ওই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির সেই বাড়ির রিসেপনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম (মৃত্যু: ২৫ অগাস্ট, ২০১৬) ঢাকার ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা (১০(১০)৯৬) দায়ের করেন। তিন মাসের বেশি সময় ধরে তদন্তের সিআইডির সে সময়কার সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাহহার আকন্দ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তদন্তে বঙ্গবন্ধু হত্যায় সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও আগেই তারা মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়।
যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যাওয়া খুনি ফারুক-রশিদ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ১৯৭৬ সালে যে টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ধারণ করা সেই সাক্ষাৎকারের ভিডিওসহ ৪৬ ধরনের আলামত অভিযোগপত্রের সঙ্গে আদালতে জমা দেওয়া হয়। বিচারের সব প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল (মৃত্যু: ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪) বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৭১ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক ১৮ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বাকিদের খালাসের রায় দেন তিনি। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেয়। বিভক্ত রায় হওয়ায় নিয়মানুযায়ী মামলাটি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। তৃতীয় বেঞ্চের রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।
আরো পড়ুন: পদ্মা সেতু সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান
মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামি- সাবেক মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক রহমান, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব.) নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান, লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ ও লে. কর্নেল আজিজ পাশা (অব.)।
তাদের অপরাধের জন্য তাদের প্রত্যেককে দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪ ধারা মতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো।
২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে সেই বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যেখানে হাইকোর্ট থেকে রায় চলে এসেছে, মামলার আনুষ্ঠানিকতাও আর খুব বেশি বাকি নেই, সেখানে দীর্ঘ ৬ বছর আপিল বিভাগের সাতজন বিচারক মামলার শুনানিতে বিব্রতবোধ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানিতে উচ্চ আদালতের বিচারকরা বিব্রতবোধ করবেন- এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসবার পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করে দেয়। এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বজলুল হুদা, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন ও মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড ও মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হয়।
ফাঁসি কার্যকরের পর শহীদুল হক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে খবরটা জানালেন। শুনে ভারী কন্ঠে শেখ হাসিনা তাকে বললেন, ‘সব দিকে খেয়াল রেখো। মৃতদেহগুলো ঠিকমতো পৌঁছে দিও।’
এই হত্যার বিচার পেতে দীর্ঘ ৩৫ বছর লেগেছিল।