মা হওয়া একটি মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয়। গর্ভে শিশুর আগমনের খবর পাওয়ার সাথে সাথেই সতর্ক হয়ে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হয়। গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের পুষ্টির চাহিদা সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হয়।
তাই মায়ের সঠিকভাবে খাদ্য গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা একজন চিকিৎসক ভালভাবে দিতে পারবেন। তবে, এই সময়ে সাধারণত পুষ্টিকর আহার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। এই তালিকায় ফল, শাক-সবজি, ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, পানি, বাদাম ইত্যাদি থাকে। এগুলো গর্ভবতী মায়ের বডিকে সুস্থ রাখতে এবং শিশুর বৃদ্ধি ও সুগঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।
মনে রাখবেন, হোল গ্রেইন খাদ্য এই গুচ্ছে স্থান পেতে হবে। শিশুর বৃদ্ধিতে এই পুষ্টিগুন খুব দরকারি। এই পোস্টে বিস্তারিত তালিকা দেওয়া হলো।
প্রসূতি মেয়ের পুষ্টিকর খাবার বারবার খেতে হয়। গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা ছবি: মাতিলদা ওর্মউড |
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা: শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য
আমরা এখানে সাধারণত অনুসরণীয় একটি আহার তালিকা সংগ্রহ করে দিচ্ছি। হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে ফুলে যাওয়া, বমি বমি ভাব এবং মেজাজের পরিবর্তনের মতো শারীরিক লক্ষণ অনুভব এ সময় হয়। একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য চার্ট আপনাকে এই পরিবর্তন আরও ভালভাবে মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে।
একজন প্রেগন্যান্ট মায়ের প্রতিদিনের ফুডলিস্টে নিম্নলিখিত খাদ্যসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে আমরা মনে করি , তবে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এ লিস্ট প্রস্তুত করবেন। কারণ বয়স, ওজন ও উচ্চতা ভেদে এবং নারীর দেহের গঠন ও পুষ্টি চাহিদা বিবেচনায় গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা কিছুুটা পরিবর্তন হতে পারে।
- ফল এবং শাকসবজি: এসবে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল এবং ফাইবার থাকে। এগুলো গর্ভবতী মায়ের দেহকে সুস্থ রাখতে এবং শিশুর বেড়ে ওঠা ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।
- হোল গ্রেইন শস্য: Whole grains মানে পূর্ণ শস্য। এতে অনেক পরিমাণে ফাইবার, নিউট্রিয়েন্ট এবং খনিজ থাকে। এসব খাদ্য প্রেগন্যান্ট নারীর শরীরকে শক্তি দেয় এবং কষা দূর করতে সাহায্য করে।
- প্রোটিন: প্রোটিন আমাদের দেহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। এটি অন্তঃসত্ত্বা মায়ের গাত্র এবং শিশুর বড় হওয়া ও বিকাশের জন্য প্রয়োজন। প্রোটিন যুক্ত খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্য।
- দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য: এতে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন এবং ভিটামিন ডি থাকে। এগুলো প্রেগন্যান্ট নারীর হাড় এবং দাঁতকে শক্তিশালী করে এবং শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।
- মাছ: মাছতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শিশুর মাথা এবং চোখের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। মাছতে প্রোটিনও থাকে যা গর্ভবতী মায়ের দেহ এবং শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজন।
- পেস্তা বাদাম এবং বীজ: বাদাম এবং বীজসমূহে ফাইবার, প্রোটিন, নিউট্রিয়েন্ট এবং খনিজ থাকে। এগুলো প্রেগন্যান্ট নারীর দেহকে শক্তি দেয় এবং কনস্টিপেশন দূর করতে সাহায্য করে।
- পানি: পানি অন্তঃসত্ত্বা মায়ের এবং শিশুর জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। পানি দেহকে হাইড্রেটেড রাখে এবং শিশুর দৈহিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। প্রেগন্যান্ট নারীর প্রতিদিন অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের খাবার তালিকা
কী কী ফল খাবেন: গর্ভবতী মায়ের ফল খাবার তালিকা
- ফলগুলো অবশ্যই ধুয়ে খেতে হবে।
- ফলসমূহ বেশি পরিমাণে খেতে হবে না।
- ফলগুলো যেন পচা বা নষ্ট না হয়।
- ফলমূল যেন অতিরিক্ত মিষ্টি না হয়।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা: মাস অনুসারে (০১-১০)
১ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
২ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
৩ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকা গর্ভধারণের সময়কাল অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। গর্ভধারণের তৃতীয় মাসটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, কারণ এই সময়কালে ভ্রূণটি তার বিকাশ অব্যাহত রাখে এবং তার অঙ্গ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ পূর্ণতা লাভ করে। প্রেগন্যান্ট নারীর এই সময়ে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের তৃতীয় মাসের খাদ্য লিস্টে যেসব খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত সেগুলো হল:
ভিটামিন: ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবার থাকে যা মা এবং শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিন অন্তত পাঁচ পদ ফল খাওয়া উচিত।
ফুলকপি: এগুলোয় বেশি পরিমাণে নিউট্রিয়েন্ট, খনিজ এবং আঁশ থাকে। প্রেগন্যান্ট নারীর প্রতিদিন কমপক্ষে কিছু শাক সবজি খাওয়া উচিত। লাল গোলাপ খেতে পারেন।
হোল গ্রেইন গম: এ খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা হজম সহায়ক, স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। এই আহারে প্রোটিন এবং আয়রনও থাকে যা মা এবং শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়।
মাংস: এগুলো মা এবং সন্তানের কোষের বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিন অন্তত ৭৫ গ্রাম প্রোটিন খাওয়া উচিত।
পনির: এসব পণ্যে অনেক পরিমাণে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন এবং ভিটামিন ডি থাকে যা মা এবং শিশুর হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। দুধ খেতে পারেন।
হাঁসের ডিম: ডিম বেশি পরিমাণে প্রোটিন এবং ফলিক অ্যাসিড যুক্ত যা মা এবং ছোট্ট মানুষটির স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের প্রতিদিন এক বা দুটি ডিম খাওয়া উচিত।
রুই মাছ: মাছের গুন হলো এতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যা মা এবং শিশুর ব্রেইন স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। গর্ভবতী প্রসূতির প্রতি সপ্তাহে দুই বা তিনবার রুই ও অন্য মাছ খাওয়া উচিত।
তিল বীজ: বীজে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফাইবার এবং অন্যান্য পুষ্টি থাকে যা মা এবং শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। প্রেগন্যান্ট নারীরা প্রতিদিন অন্তত এক মুঠো তিল বীজ খেতে পারেন।
পানি: অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানীয় জল পান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রেগন্যান্ট নারীর প্রতিদিন নিদেনপক্ষে আট গ্লাস পানি পান করা উচিত।
৪ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
৫ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
৬ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
৭ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
খাবারের ধরন | খাবার |
সকালের নাস্তা |
ওটমিল দুধের সাথে তৈরি রুটি ডিম ফল বাদাম বীজ |
দুপুরের খাবার |
সালাদ স্যুপ ভাত এবং ডাল মাছ মাংস |
স্ন্যাকস |
ফল বাদাম বীজ দই চিপস স্যান্ডউইচ |
রাতের খাবার |
মুলা ও অন্য সবজি দিয়ে ভাত সবজি দিয়ে মাছ সবজি দিয়ে মাংস সবজি দিয়ে টোফু সবজি দিয়ে স্যুপ |
তরল |
পানি ফলের রস দুধ চা কফি
|
৮ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
৯ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
১০ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ১০ মাসের প্রেগন্যান্ট নারীর জন্য, তাদের খাদ্যতালিকায় এমন খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যা তাদের এবং তাদের শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।এবার ১০ মাসের গর্ভবতী মায়েদের জন্য একটি খাদ্যসূচি দেওয়া হল:
মাংস: প্রোটিন বেবির বিকাশ এবং বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। অন্তঃসত্ত্বার প্রতিদিন প্রায় ৭৫ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত। প্রোটিন যুক্ত খাদ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মাংস, মাছ, ডিম, দুগ্ধজাত পণ্য, ডাল, শিম এবং কাঠ বাদাম।
সয়া দুধ: ক্যালসিয়াম শিশুর হাড় এবং দাঁতের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। প্রেগন্যান্ট নারীর প্রতিদিন প্রায় ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করা উচিত। ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার হিসেবে রয়েছে দুধ, দই, পনির, ব্রকোলি, ক্যালসিয়াম যুক্ত সয়া দুধ এবং সয়া পনির।
অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের অবশ্যই তাদের ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য নির্ঘন্ট তৈরি করা উচিত
গর্ভবতী মায়ের কোন খাবার খাওয়া যাবে না
গর্ভবতী মায়েদের কিছু খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এসবে আছে:
- কাঁচা মাংস: কাঁচা মাংসে জীবাণু থাকতে পারে যা অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের এবং শিশুর অসুস্থতা করতে পারে।
- কাঁচা ডিম: কাঁচা ডিমেও জীবাণু থাকতে পারে যা প্রেগন্যান্ট নারীর এবং বেবির অবস্থা খারাপ করতে পারে।
- অ্যালকোহল: অ্যালকোহল গর্ভবতী প্রসূতির এবং শিশুর জন্য ক্ষতিকারক। এটি বেবির জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করতে পারে।
- ধুমপান: তামাক প্রেগন্যান্ট নারীর এবং শিশুর জন্য ক্ষতিকারক। এটি গর্ভস্থের জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে এবং শিশুর ওজন কম হতে পারে।
- ক্যাফিন: ক্যাফিন গর্ভবতী মায়েদের এবং বেবির জন্য ক্ষতিকারক। এটি শিশুর ওজন কম হতে পারে এবং বেবির জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করতে পারে।
খাদ্য তালিকা তৈরি করার সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে
গর্ভবতী মায়েদের খাদ্য তালিকা তৈরির সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে:
পুষ্টিকর খাবার বেছে নিন: প্রেগন্যান্ট নারীর খাদ্য সারণিতে অবশ্যই পুষ্টিকর খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পরিমিত পরিমাণে আহার খান: অন্তঃসত্ত্বা প্রসূতির অতিরিক্ত খাবার খাওয়া উচিত নয়।
নিয়মিত খাদ্য খান: প্রেগন্যান্ট মায়েদের দিনে ছয়বার তো খাদ্য খেতেই হয়।
স্বাস্থ্যকর খাবার খান: গর্ভবতী মায়েদের অবশ্যই স্বাস্থ্যকর ফুড খেতে হবে।
ডাক্তারের সাথে পরামর্শ: অন্তঃসত্ত্বা প্রসূতির খাদ্য নির্ঘন্ট তৈরিতে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা ভাল।
গর্ভবতী মায়েদের খাদ্য গ্রহণে যা বিবেচনা করা উচিত
- পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা
- ওজন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা, সুখে থাকা
- খাবারের স্বাদ ও গন্ধের পরিবর্তনসমূহ মোকাবেলা করা
- অসুস্থতা প্রতিরোধ করা
- শিশুর বিকাশের জন্য সবচেয়ে ভাল পরিবেশ তৈরি করা
আমরা জানলাম, গর্ভবতী মায়েদের সঠিকভাবে খাওয়া অবশ্য পালনীয়। এটি প্রেগন্যান্ট নারীর এবং শিশুটির স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। হোল গ্রেইন বা পূর্ণ গুন খাদ্য শস্য খেতে হবে। মাছ মাংস, ভাত-রুটির সাথে ডিম দুধ, সবজি, ফল, শাক, বাদাম, খাওয়া এসময়টাতে বেশ দরকারি। আমরা আলোচনা করেছি যে কী কী খাওয়া যাবে এই সময়ে; আর কী খাওয়া যাবে না। পাশাপাশি কোন কোন বিষয় খেয়াল রাখতে হবে প্রসূতির খাদ্য প্রস্তুত করার সময়।